গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে এই যুদ্ধে গাজায় নিহত হয়েছে ২৯ হাজার ৫১৪ ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এই সময়ে আহত হয়েছে আরও ৬৯ হাজার ৬১৬ ফিলিস্তিনি।
গাজায় শুধু বোমা হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি ইসরায়েল। দেশটির বাহিনী স্থল অভিযান চালাতে গিয়ে ওই উপত্যকার প্রতিটি পুরুষকে নির্যাতন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এর রকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দিনটি ছিল শুক্রবার। সামের (২২) ও ওমর (২৮) খুব সকালেই ঘুম থেকে ওঠে। জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে অবস্থিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে জুমার নামাজ আদায় করার ইচ্ছা তাদের।
দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত ইসাবিয়া এলাকায় সামের ও ওমরদের বাড়ি। সেখান থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ আল-আকসার। শহরের হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ এ মসজিদে আদায় করে থাকেন। তরুণ সামের ও ওমর তাদেরই দুজন।
আল-আকসায় জুমার নামাজ আদায় করতে সেদিন সামের ও ওমর যখন দামেস্ক গেটে পৌঁছান, তখন ইসরায়েলি বাহিনী তাদের থামতে বলে। ওল্ড সিটিতে ঢুকতে ফিলিস্তিনিরা এই (দামেস্ক গেট) প্রধান প্রবেশপথটি ব্যবহার করে থাকেন।
সেখানে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য সামের ও ওমরকে প্রশ্ন করেন- কোথা থেকে এলে? তাদের জবাব, ইসাবিয়া।
ইসাবিয়ায় ফিরে যাও এবং সেখানেই নামাজ পড়ো—পাল্টা জবাব নিরাপত্তা বাহিনীর ওই সদস্যের।
জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়ার পথে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর এমন প্রশ্নের মুখে পড়া ও ফেরত যাওয়ার নির্দেশ পাওয়ার কথা জানান আরও কয়েকজন ফিলিস্তিনি।
গত ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে ওল্ড সিটিতে প্রবেশে চূড়ান্ত রকমের কড়াকড়ি আরোপ করে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে গত দুই শুক্রবার এ কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা হয়। এতে আরও বেশি মুসল্লি আল-আকসায় নামাজ আদায়ের সুযোগ পান।
নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে বাধা পেয়ে সামের ও ওমর মনে কষ্ট পান। ফিরে যাওয়া শুরু করেন তারা। পথে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশিচৌকির কাছে একটি কেবিন থেকে পানি খেতে কিছু একটা ধরতে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরই ওই বাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের দুজনকে স্থান ত্যাগ করতে বলেন। কারণ হিসেবে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তারা।
এ ঘটনার পর সামের বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের ধাক্কাতে শুরু করেন ও পরে আমার বন্ধুকে পেটান। আমরা বলার চেষ্টা করেছি- আমাদের মেরো না।”
নিরাপত্তা বাহিনীর এই সদস্যদের অভিশাপ দেন ফিলিস্তিনি তরুণ ওমর। এর আগে তাদের দু’জনকে প্রায় ৫০০ মিটার ধাওয়া করে লাঠি দিয়ে পেটান তারা।
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যখন দুই তরুণকে ধাওয়া করেন ও পেটান, তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আল–জাজিরার সংবাদদাতাও। তিনি ওই সদস্যদের একজনকে বলতে শোনেন, “ওদের পা ভেঙে দাও, যেন আর ফিরে আসতে না পারে।”
মারধরে ২৮ বছরের তরুণ ওমরের আঘাত ছিল তার বন্ধুর চেয়ে মারাত্মক। তার পায়ে এমন দাগ পড়ে যে মনে হচ্ছিল সেখানে পুড়ে গেছে। ব্যথায় কাতর ওমর হাঁটতে পারছিলেন না।
এদিকে আহত সামের বলছিলেন, “আমরা এখানে (জেরুজালেম) থাকি, তারা সেটা চায় না। তারা দেশ থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিতে চায়। জেরুজালেমে কোনও পুরুষের জন্য জীবন বলতে কিছু নেই। এখানে শুধুই একজন ফিলিস্তিনি পুরুষ হিসেবে টিকে থাকাটাও তাদের (ইসরায়েল) সহ্য হয় না।”
সামের জানান, এরপরও জেরুজালেমে তাদের শক্তভাবে টিকে থাকা ছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ নেই।
তিনি বলেন, “দিন শেষে এটি (ইসরায়েলি বাহিনীর কর্মকাণ্ড) তাদের সামরিক দখলদারত্ব। আমরা কখনওই এখান থেকে চলে যাব না, তারা যা-ই করুক।”
এ আলাপ শেষে সামের ও ওমর একটি বাসে উঠে তাদের বাড়ির উদ্দেশে ফিরে যান।
ওল্ড সিটির বাসিন্দা ও একটি দোকানের মালিক আবু মোহাম্মদ (৩০) বলেন, ৭ অক্টোবরের পর বিশেষত প্রথম কয়েক দিন ও সপ্তাহ ইসরায়েলি সেনারা এখানে (ওল্ড সিটি) বিকাল পাঁচটার পর থেকে কড়াকড়িভাবে কারফিউ কার্যকর করে।
তিনি আরও বলেন, “ওই সময়ের পর রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিত না সেনারা। কেউ দাঁড়ালে তারা পেটাতেন, উসকানিমূলক তল্লাশি ও গালিগালাজ করতেন।”
আবু মোহাম্মদ বলেন, যেকোনও সময় যেকোনও পুরুষ মানুষ ওল্ড সিটিতে ঢুকতে চাইলে সেনারা তার তল্লাশি শুরু করেন। প্রথমে একদল সেনা তাকে তল্লাশি করবেন। এ সময় তারা কনুই বা হাঁটু দিয়ে তাকে আঘাত ও কিছু বলানোর চেষ্টা করবেন।
তিন সন্তানের বাবা এই ফিলিস্তিনি বলেন, “এই সময় আপনি যদি কিছু বলেন, দেখবেন তারা সবাই আপনার ওপর চড়ে বসেছেন। তারা আপনার মাথায় ঘুষি মারছেন, সারা দেহে মারছেন। কখনও কখনও আপনাকে হাসপাতালে যেতে হতে পারে।”
আবু মোহাম্মদ বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা বয়স্ক ও অল্পবয়সীদের মাঝে কোনও পার্থক্য করে না। আমি সেনাদের বয়স্ক মানুষকেও পেটাতে দেখেছি। তারা কোনও কিছুর তোয়াক্কা করেন না। শহরে এমন কোনও ফিলিস্তিনি পুরুষ পাওয়া যাবে না, যিনি তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হননি। সূত্র: আল জাজিরা